রাত প্রায় এগারোটা।
রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন রাকিব সাহেব।
তার এতো রাতে রাস্তা দিয়ে হাটার কোনও যৌক্তিকতা নেই। কারন তিনি কখনই তেমন স্বাস্থ্যসচেতন না।
ছেলের সাথে রাগারাগি করে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কথা কাটাকাটির বিষয় অত্যন্তই তুচ্ছ।
কিন্তু রাকিব সাহেব সেই ব্যাপারটাকে বড় করে দেখছেন।
তার ছোট ছেলে, তাই তিনি আরও একটু বেশি গুরুত্বের সাথেই দেখছেন। তার ছেলে এখন নবম শ্রেণীতে পড়ে, এখন সে কোন বিষয় চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিবে এই নিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া করেছে। সবে তার ছেলে রায়হান অষ্টম শ্রেণী পেরিয়ে নবমে উঠেছে। কথা শোনে না, জেদি, তবে পড়াশোনায় ফাকি কম দেয়। তাই রেজাল্ট ভালো। তবুও রাকিব সাহেব তাকে চাপে রাখেন। সার্জন বানাবেন ছেলেকে। এর মানেই ডাক্তার বানাবেন।
তাই তাকে বলেছিলেন হায়ারম্যাথ চতুর্থ বিষয়ে রাখতে। সে কারো কথা না শুনে বায়োলজি দিয়ে এসেছে। এই কথা বাসায় জানানোর পর রাকিব সাহেব যাচ্ছেতাই ব্যাবহার করেছেন ছেলের সাথে।
সবসময় এই ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন ছেলে ডাক্তার হবে, বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে।
আর এই বেয়াদব ছেলে কিনা গিয়ে সোজা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ধান্দায় আছে। ভাবতে ভাবতেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। কিছুক্ষন হাটার পর একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লেন তাতে। উদ্দেশ্য গুলশান লেক। নেমে এসে লেকের ধারে হাটতে লাগলেন তিনি। ভাবতে লাগলেন একটু আগের কথা...
রেগে গিয়ে রায়হানকে চড় মারেন তিনি। রায়হানের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে শান্ত স্বরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি যা পড়তে চাই তাই পড়বো, আমাকে দিয়ে জোড় করবে না আব্বু, নাহলে আমি পড়াশোনাই ছেড়ে দেবো। এই বেয়াড়া রকমের কথা শুনে রাকিব সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে ওঠে। চিৎকার করে ছেলেকে বেশ কিছু আজে বাজে কথা শোনান তিনি।
“ছেড়ে দে পড়াশোনা! তোকে পড়তে বলেছে কে? যা আমার বাসা থেকে বেরো, তোর খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেবো। হয় তুই থাকবি আমার বাড়িতে, নাইলে আমি...”
রায়হান সাথে সাথে ঘরের দরজা আটকে দিয়ে ভেতরে বসে থাকে, বাবার চিৎকার তার শুনতে ইচ্ছে করছে না। আর রাকিব সাহেব সাথে সাথে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কেউ আটকালোনা দেখে বাড়িতে ফিরবেন না বলে দিয়ে গেলেন।
রায়হানের ছোটবেলায় প্রতিবেশি ইসমাইল ভাইয়াকে দেখে স্বপ্ন, কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ার হবে, গেইম বানাবে, সফটওয়ার বানাবে। ইসমাইল ভাইয়া এখন ব্রিটেনে থাকে, ওখানে তার নিজের সফটওয়ার ফার্ম তৈরি করেছে। সে যা চায়, যা পারে, তাইতো সে করবে, তাকে কেন জোর করেও ডাক্তারই হতে হবে? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় রায়হান। মা তাকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডেকেও তুলতে পারে না, আসলে তার ওঠার কোনো ইচ্ছেই নেই, বাবার ওপর অভিমান তাকে আরও জেদি করে তুলেছে।
*
রাকিব সাহেব চতুর্থ সিগারেটটা শেষ করলেন পার্কের বেঞ্চে বসে। ভাবছেন রাতে বাড়ি যাবেন না। বন্ধুবান্ধব নাহলে আত্মীয়ের বাসায় থাকবেন। কিন্তু ফ্যাসাদে পড়লেন এই মনে করে যে, এই এলাকায় তার অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং তার আত্মীয় সকলেই অনেক দূরে দূরে থাকে, আর পকেটে টাকাও সীমিত এনেছেন, মানিব্যাগ আর মোবাইলফোন আনতেই ভুলে গেছেন।
বসে বসে ঠাণ্ডা বাতাস উপভোগ করতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ কিছু দুরের একটা বেঞ্চে তার চোখ পড়লো, হ্যাঁ, একটা ছেলেই বসে আছে। বয়স একুশ বাইশ হবে হয়তো, মাথা নুইয়ে রেখেছে।
হঠাৎ ভয় পেলেন রাকিব সাহেব, মাদকাসক্ত হতে পারে, নাহলে এতো রাতে এখানে কি করছে? অথবা ছিনতাইকারীও হতে পারে। কিন্তু আপন কৌতূহলবশত তিনি ছেলেটার কাছে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন। এবার তিনি চিনতে পারলেন ছেলেটাকে, হ্যাঁ, তার প্রতিবেশি এঞ্জিনিয়ার রহিম সাহেবের ছেলে, রাফিন।
এবার এইচএসসি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। এর বেশি খোঁজ তিনি নেন নি।
মাথা তুলে তাকালো রাফিন, চোখ লাল, দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে,
“জ্বি আঙ্কেল! আপনি এতো রাতে! এখানে?”
“আমারো প্রশ্ন তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো?”
“কিছু না”
“কিছু যে একটা হয়েছে তোমার চোখের পানি দেখেই বুঝতে পারছি, কি হয়েছে বলো...”
“আঙ্কেল বাসায় একটা সমস্যা হয়েছে”
“কি সমস্যা?”
“আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিপলিতে চান্স পাইনি, কারন আমার জিপিএ ছিল না, আমি অনেক কষ্টে জার্নালিজমে চান্স পেয়েছি। এখন আব্বা বলছে তার বংশে কেউ নাকি কেউ এঞ্জিনিয়ার বাদে অন্য কিছু হয় নি। তার বংশে আমার যায়গা নেই। আব্বা আমার সাথে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে, তার বাড়িতে তার বংশের কুলাঙ্গার রাখবে না। তাই আমি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছি”
“কেন? জার্নালিজম কি কম ভালো নাকি? চাইলে তো তুমি এখান থেকেই যেকোনো সংবাদপত্রে বা মিডিয়ায় ভালো পদে জব করতে পারবে। এছাড়া ইউনিভার্সিটিতে তুমি লেকচারার হিসেবে জব করতে পারো”
“আব্বাকে সে কথা কে বোঝাবে? আমি আমার মতো পড়তে চেয়েছিলাম, উনি কেবলই আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য চাপ দিতেন।”
“কি পড়তে চেয়েছিলে তুমি?”
“সাংবাদিকতাই পড়তে চেয়েছিলাম, পড়তে চাইও... সাংবাদিক হবারই ইচ্ছা ছিলো অনেকদিন, কিন্তু আব্বা বাঁধ সাধছে”
“আমি দেখি তোমার আব্বাকে বুঝিয়ে বলবো...”
“দেরি হয়ে গেছে যে, আঙ্কেল...”
“মানে??”
“কিছু না”
হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায় রাফিন, উঠে দাঁড়ায়, ফিরে তাকায় রাকিব সাহেবের দিকে,
“আঙ্কেল, আমাদের বড় বড় স্বপ্নগুলো ভাঙবেন না, কারন আমাদের ভবিষ্যৎ কেবল আমাদেরই, আপনাদের নয়, চলি আজ, বিদায়”
লম্বা এবং ধীরপদবিক্ষেপে লেকের পাশে ছোট জংলা মতো জায়গার দিকে হাটতে থাকে রাফিন, এবং এক সময় আঁধারে মিলিয়ে যায়।
স্থির হয়ে লম্বা সময় বসে থাকলেন। ভাবলেন রাফিনের শেষ কথাগুলো। ছেলেটাতো খুব একটা ভুল বলে যায়নি। ওদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে, আমরা যদি তাদের স্বপ্নের মতো তাদের নিজেদের গড়ে তোলার জন্য সহযোগিতা করতে পারি তবেই না ওরা বড় হয়ে সত্যিকারের মানুষ হবে। মনের মতো কাজ করে আনন্দ পাবে। সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ তৈরি করবে।
হেঁটে হেঁটেই বাসায় ফিরলেন উনি।
উঁকি দিয়ে দেখলেন প্রথমে রায়হানের ঘরে, না, ঘুমিয়ে পড়েছে। পড়বারই কথা, ঘড়ির কাঁটা রাত ২টার ঘর ছুঁইছুঁই।
সকাল সাড়ে ৬টা।
ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে খবরের কাগজটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন রাকিব সাহেব। অফিস এগারোটায়, ন’টার সময় বেরিয়ে যাবেন। তার স্ত্রী আফসানা আহমেদ চা নিয়ে আসলেন।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজে নজর দিতে লাগলেন তিনি, পাশে রায়হানের আম্মা আফসানা আহমেদ চা খাচ্ছিলেন। রায়হানের আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেন রায়হান সাহেব, “রায়হান ঘুম থেকে উঠেছে নাকি?”
“অনেক আগেই, তোমার আগেই নামাজ পড়ে বাহিরে গেছে।”
“তাই নাকি?”
“হুম”
ঠিক তখনি বেল বেজে উঠলো, রায়হান আসেছে, সকালে হাঁটা তার অভ্যাস।
কিছুক্ষন পর রায়হানকে ডেকে পাঠালেন রাকিব সাহেব।
“কিছু খেয়েছো?”
“না”
“বসো এখানে”
একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে সে বাবার মুখোমুখি বসলো।
“চতুর্থ বিষয় কি নিতে চাও?”
“বায়োলজি”
“কেন?”
ইতস্তত করে রায়হান বলে,
“আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো, সেজন্যে বায়োলজিকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি না”
“আচ্ছা, ফোর্থ সাবজেক্ট বায়োলজি নাও, আর তোমার যে কোনো দরকারে আমার সাথে কথা বলো, কেমন?”
“আচ্ছা আব্বু”
বাবার পরিবর্তন টের পায় রায়হান, অবাক হয়ে সে তার অন্য বাবাকে দেখতে থাকে।
তারপর হাসিমুখে চলে যায় নিজের ঘরে।
প্রশান্তির একটা শ্বাস ফেলেন রাকিব সাহেব, ছেলের হাসিমুখ যেন তার অনেক দুশ্চিন্তা হাল্কা করে দিলো। নিশ্চিন্ত মনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন তিনি।
Image from AmarBlog.Com